এই যে আমরা বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি আঁকলাম এর প্রতিটি ঈশ্বরের একেকটি রূপ। ঈশ্বরকে এইভাবে আমরা বিভিন্নরূপে আরাধনা করে থাকি।
ঈশ্বর নিরাকার তাই আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। তবে তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে অনুভব করি। এই নিরাকার ব্রহ্মরূপে তিনি সর্বত্র বিরাজিত। বিশ্বের সবকিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি জ্ঞানীর কাছে ব্রহ্ম, যোগীর কাছে পরমাত্মা এবং ভক্তের কাছে ভগবান রূপে পরিচিত। ঈশ্বরকে বলা হয় "স্বয়ম্ভু'। কারণ তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিতা, শুষ্ক ও পরম পবিত্র। তিনি সকল কর্মের ফলদাতা। যে যেমন কাজ করে তিনি তাকে সেই কাজ অনুসারে ফল প্রদান করেন। ঈশ্বরের রূপের অন্ত নাই। অনন্তরূপ তাঁর। তিনি সর্বব্যাপী।
কোনো বিশেষ শক্তির প্রকাশ ঘটাতে সাকার রূপে ঈশ্বর পৃথিবীতে আসেন। ঈশ্বরের কোনো বিশেষ গুণ বা শক্তির সাকার রূপ হলো দেবতা বা দেব-দেবী। হিন্দুধর্মে বিভিন্ন দেব-দেবীর কথা উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া ঈশ্বর আত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন।
ঈশ্বর কখনো কখনো জীবদেহ ধারণ করে পৃথিবীতে আসেন। তাঁর এই আসা বা অবতীর্ণ হওয়াকে বলে অবতার। তিনি অবতীর্ণ হন দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য। পৃথিবীতে শান্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সাকার রূপ ধারণ করেন। সাকার রূপে আবির্ভূত হয়ে তিনি নানা কর্মের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করেন।
তবে নিরাকার এবং সাকার রূপ মূলত সেই এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই ভিন্ন প্রকাশ মাত্র।
দেব-দেবী রূপে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ
ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। 'একনের অদ্বিতীয়ম্'। অনন্ত তাঁর গুণ ও শক্তি। তাঁর এই গুণ বা শক্তি দেখা যায় না। তবে অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। যেমন- আলো, বাতাস, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি দেখা যায় না। শুধু অস্তিত্ব বা উপস্থিতি অনুভব করা যায়। তেমনি ঈশ্বরকেও দেখা যায় না, অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। তিনি নিরাকার, সর্বশক্তিমান। নিরাকার ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির সাকার রূপই হচ্ছেন দেব-দেবী। অর্থাৎ দেব-দেবীরা ঈশ্বরের বিশেষ গুণ বা শক্তিরই মূর্ত প্রকাশ মাত্র। আমরা ঈশ্বরের সাকাররূপী বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করি। যেমন- ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণুরূপে ঈশ্বর জীবজগৎকে রক্ষা ও প্রতিপালন করেন, শিবরূপে তিনি ধ্বংস করে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করেন। বিদ্যাশক্তির সাকার রূপ সরস্বতী দেবী, ধনসম্পদের শক্তির রূপ লক্ষ্মীদেবী, সকল শক্তির সম্মিলিত রূপ দুর্গাদেবী। এই দেব-দেবীদের পূজা করার মধ্য দিয়ে আমরা মূলত সেই এক ঈশ্বরেরই পূজা করে থাকি।
অবতার হিসেবে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ
ঈশ্বরকে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু তিনি সর্বত্র অদৃশ্যভাবে অবস্থান করেন। তবে ঈশ্বর কখনো কখনো বিশেষ রূপ ধরে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হোন। অনেক সময় তিনি মানুষের মতো দেহ ধারণ করেন। এই দেহ ধারণের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। তিনি দেহ ধারণ করে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন। এ সম্পর্কে
শ্রীনন্তগবদ্গীতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্। ৪/৭
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। ৪/৮
শব্দার্থ যদা যদা হি যখন যখনই; ধর্মস্য গ্লানিঃ- ধর্মের অবনতি; ভবতি হয়; ভারত- হে ভারত (অর্জুন); অভ্যুত্থানম্ - বৃদ্ধি; অধর্মস্য অধর্মের তদা তখন; আত্মানং- নিজেকে; সৃজামি- সৃষ্টি করি; অহম্-আমি। পরিত্রাণায়- রক্ষার জন্য; সাধুনাং সৎ ব্যক্তিদের বিনাশায় বিনাশের জন্য; এবং দুষ্কৃতাম্ অসৎ বা দুষ্টদের; ধর্মসংস্থাপনার্থায়ন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য সম্ভবামি অবতীর্ণ হই; যুগে যুগে- যুগে যুগে।
সরলার্থ: পৃথিবীতে যখনই ধর্মের অবনতি হয় ও অধর্ম বেড়ে যায়, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। সং ব্যক্তিদের রক্ষা, অসৎ বা দুষ্ট ব্যক্তিদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
পৃথিবীতে ঈশ্বরের এরূপ অবতরণকে অবতার বলা হয়। তিনি নানারূপে অবতীর্ণ হন। এই অবতারগণ মানুষের এবং জগতের মঙ্গল করেন। বিভিন্ন যুগে ভগবানের বিশেষ দশটি অবতারের কথা বর্ণিত হয়েছে। যথা- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুধ ও কল্কি
মৎস্য অবতার:
ভগবান বিষ্ণুর প্রথম অবতার হলো মৎস্য অবতার। এই অবতারের শরীরের উপরের অংশ দেখতে মানুষের মতো। নিচের অংশ মাছের মতো। অনেক বছর আগে সত্যব্রত নামে একজন রাজা ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে হঠাৎ পৃথিবীতে অনেক দুর্যোগ দেখা দেয়। ধর্মের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। অধর্মের মাত্রা বেড়ে যায়। রাজা তখন ঈশ্বরের করুণা কামনা করেন। একদিন স্নানের সময় রাজা সতারতের নিকট এসে একটি ছোট পুঁটি মাছ প্রাণ ভিক্ষা চায়। রাজা কমন্ডলুতে করে মাছটিকে বাড়ি নিয়ে এলেন। কিন্তু অবাক কান্ড। মাছটির আকার ক্রমশ বাড়তে থাকে। মাছটিকে পুকুর, নদী কোথাও রাখা যাচ্ছিল না। মাছটি আকারে বাড়তেই থাকে। তখন রাজা ভাবলেন, এটা আসলে মাছ নয়। নিশ্চয়ই ভগবান নারায়ণের কোনো গ্রুপ। রাজা তখন মৎস্যরূপী নারায়ণের স্তব-স্তুতি করতে লাগলেন। স্তব-স্তুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে মৎস্যরূপী নারায়ণ বললেন, সাত দিনের মধ্যে এ জগতের প্রলয় হবে। সে সময় তোমার ঘাটে একটি স্বর্ণতরী ভিড়বে। তুমি বেদ, সব রকমের জীবদম্পতি, খাদ্য-শস্য ও যুদ্ধবীজ সংগ্রহ করে তাদের নিয়ে সেই নৌকায় উঠবে। আমি তখন শৃঙ্গধারী মৎস্যরূপে আবির্ভূত হব। তুমি তোমার নৌকাটি আমার শৃঙ্গের সঙ্গে বেঁধে রাখবে।
মহাপ্রলয় শুরু হলো। মৎস্যরূপী নারায়ণের নির্দেশ অনুসারে রাজা কাজ করলেন। ধ্বংসের হাত থেকে রাজা, তার সঙ্গী-সাথি এবং অন্যান্য দ্রব্য-সামগ্রী রক্ষা পেল। এভাবে মৎস্যরূপী ভগবান বিষ্ণু সৃষ্টিকে রক্ষা করলেন। রক্ষা পেল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদ।
নৃসিংহ অবতার
নৃসিংহ বা নরসিংহ রূপ হচ্ছে বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার। নৃ বা নর অর্থ মানুষ। নৃসিংহ হচ্ছে মানুষ ও সিংহের মিলিত রূপ। মাথা সিংহের মতো আর শরীর মানুষের মতো। আবার নখগুলো সিংহের মতো। নিজের ভাই হিরণ্যাক্ষকে বরাহরূপী বিষ্ণু হত্যা করেন। এতে হিরণ্যকশিপু প্রচণ্ড রেখে বিষ্ণু বিরোধী হয়ে উঠেন। কিন্তু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। হিরণ্যকশিপু নানা কৌশলে প্রহ্লাদকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। প্রতিবারেই বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ রক্ষা পায়।
একদিন প্রচণ্ড রেগে হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞেস করলেন বল তোর বিষ্ণু কোথায় থাকে?
প্রহ্লাদ উত্তর দিল- ভগবান বিষ্ণু সব জায়গায়ই থাকেন।
তখন হিরণ্যকশিপু তার প্রাসাদের এক স্ফটিকস্তম্ভ দেখিয়ে জানতে চাইলেন- এর মধ্যেও কি তোর বিষ্ণু আছে?
প্রহ্লাদ বিনীতভাবে বললেন হ্যাঁ বাবা, শ্রীবিষ্ণু এখানেও আছেন। হিরণ্যকশিপু রেগে পায়ের আঘাতে সে স্তম্ভ ভেঙ্গে ফেললেন। তখনই স্তম্ভের ভিতর থেকে ভগবান বিষ্ণু ভয়ঙ্কর নৃসিংহ রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হলেন। তিনি নখ দিয়ে হিরণ্যকশিপুর উদর বিদীর্ণ করলেন। হিরণ্যকশিপুর অত্যাচার থেকে পৃথিবী রক্ষা পেল।
আরও দেখুন...